নগর পরিকল্পনাবিদ

নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিষয়টি মূলত ভূগোল, পরিবেশ বিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, স্থাপত্য বিদ্যা, অর্থনীতি, পূরকৌশল এবং সামাজিক বিজ্ঞানের সংমিশ্রণ। একজন নগর পরিকল্পনাবিদ ভূমির সুষ্ঠ ব্যবহার থেকে শুরু করে নগরের যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবেশ, পরিকাঠামো ও আঞ্চলিক পরিকল্পনার পাশাপাশি ঐতিহ্য সংরক্ষণ, বসবাসের অযোগ্য নগরকে উজ্জীবিত করা ও কৌশলগত নগর উন্নয়নের কাজ করে থাকেন। বাংলাদেশে এখন দ্রুত গতিতে নগরায়ন শুরু হওয়াতে এ পেশার চাহিদা বাড়ছে।

এক নজরে একজন নগর পরিকল্পনাবিদ

সাধারণ পদবী:নগর পরিকল্পনাবিদ
বিভাগ:নগর ও উন্নয়ন পরিকল্পনা বিভাগ
প্রতিষ্ঠানের ধরন:নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, এনজিও, সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বেসরকারি প্রজেক্ট , বিদেশী দাতা সংস্থা, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি
ক্যারিয়ারের ধরন:স্থায়ী অথবা চুক্তি ভিত্তিক
লেভেল:এন্ট্রি
অভিজ্ঞতা সীমা:প্রতিষ্ঠান সাপেক্ষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্তত ২ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।
সম্ভাব্য বেতনসীমা: সাধারণত ১৫,০০০ থেকে শুরু
সম্ভাব্য বয়সসীমা:প্রতিষ্ঠান সাপেক্ষ। কর্পোরেট হাউজ প্রতিষ্ঠান, ইউএন, এডিবি বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এ ২৫-৩৫ বছরের প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়
মূল স্কিল:পরিকল্পনার দক্ষতা, সামগ্রিক নগর ব্যবস্থা ও নগর জীবনের সকল উপাদানের স্পষ্ট ব্যবহার নিয়ে ধারণা,তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ,
বিশেষ স্কিল:ভালো আঁকাআঁকির হাত, উচ্চতর গাণিতিক বিশ্লেষণ দক্ষতা, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট

কোন ধরণের শিল্প বা ইন্ডাস্ট্রিতে একজন নগর পরিকল্পনাবিদ কাজ করেন?

একজন নগর পরিকল্পনাবিদের মূল কর্মক্ষেত্র নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, যোগাযোগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন কিংবা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশন সহ সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তর ও প্রজেক্টে কাজের সুযোগ আছে। বড় বড় হাউজিং ডেভেলপার্স প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ ও নগর উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা এনজিও এবং বিদেশী বিভিন্ন দাতা সংস্থায় নগর পরিকল্পনাবিদরা কাজ করেন। এ পেশায় গবেষণার সুযোগ প্রচুর।

একজন নগর পরিকল্পনাবিদ কী ধরনের কাজ করেন?

বাংলাদেশে সাধারনত উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে নগর পরিকল্পনাবিদের কাজ নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য পরিকল্পনা করা, যা স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী দু’প্রকারই হয়ে থাকে। সুষ্ঠু উন্নয়নের তাগিদে একটি এলাকা বা অঞ্চলের জনসংখ্যা, ভূতাত্ত্বিক বিষয়াদি, সম্পদ, আর্থসামাজিক অবস্থা ও তার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি বিবেচনা করে সম্ভাব্য সর্বোত্তম কৌশলগত পন্থা নেয়াই এক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য। এ জন্য একজন নগর পরিকল্পনাবিদকে বিভিন্ন গবেষণা যেমন এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট, স্ট্র্যাটিজিক এনভায়রনমেন্টাল এসেসমেন্ট, রিমোট সেনসিং, জিওপলিটিকাল রিসার্চ করতে হয়।

একজন নগর পরিকল্পনাবিদ কোন নগর বা আবাসন ব্যবস্থার সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগের নকশা, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-পার্ক-অফিস-আদালত-বাজারের অবস্থানের পরিকল্পনা করেন।

এছাড়াও বিশেষ সেক্টরগুলোতে (যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিবেশ, গৃহায়ণ) আলাদাভাবে বিশেষজ্ঞ নগর পরিকল্পনাবিদ কাজ করে।

একজন নগর পরিকল্পনাবিদ কী ধরনের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হয়?

নগর ও গ্রামীণ/আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী থাকতে হবে । এর পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম(GIS) নিয়ে স্নাতকোত্তর বা শর্ট কোর্স থাকলে ভালো।

একজন নগর পরিকল্পনাবিদের কী ধরনের দক্ষতা ও জ্ঞান থাকতে হয়?

  • বিভিন্ন ডিজাইনিং ও উপাত্ত সংক্রান্ত সফটওয়্যার যেমন ArcGIS, AutoCAD, SPSS এর কাজে দক্ষ হতে হবে
  • এমএস এক্সেল, এমএস এক্সেস এর মত স্প্রেডশীট সফটওয়্যার ব্যবহারে পারদর্শী হতে হবে
  • সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে
  • রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে কাজ করতে চাইলে আবাসন নকশার পাশাপাশি বিদ্যুৎ,পানি, গ্যাস লাইনের নকশার উপর দক্ষ হতে হবে
  • নগরপরিকল্পনার জ্ঞান ও দক্ষতার পাশাপাশি অবশ্যই প্রজেক্ট সম্পর্কিত জ্ঞান ও প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট এর দক্ষতা থাকতে হবে

কোথায় পড়বেন নগর পরিকল্পনা?

বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(BUET) এ স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিষয়টি চালু হয়। পরে ১৯৯১ সালে সর্বপ্রথম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা ডিসিপ্লিন স্নাতক পর্যায়ে প্রোগ্রাম চালু হয়। পরবর্তীতে বুয়েটে স্নাতক পর্যায়ে চালু হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়(JU) থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর উভয় ডিগ্রী দেওয়া হয়। এছাড়া চট্রগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(CUET), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়(RUET) এ নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা নিয়ে পড়বার সুযোগ আছে।

একজন নগর পরিকল্পনাবিদের কাজের ক্ষেত্র এবং সুযোগ কেমন?

  • বাংলাদেশে নগরায়ন ত্বরান্বিত হওয়াতে নগর পরিকল্পনাবিদদের কাজের সুযোগ বাড়ছে। ১২ টি সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, চট্রগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষ(CDA), খুলনা উন্নয়ন কতৃপক্ষ(KDA), রাজশাহী উন্নয়ন কতৃপক্ষ(RDA), রংপুর-দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস(RDRC), একশো এর অধিক ‘ক’ শ্রেণীর পৌরসভাতে নগর পরিকল্পনাবিদেরা কাজ করছেন। এছাড়াও আরবান ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টরেট (UDD) তে কাজের সুযোগ আছে।
  • গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিষয়ক, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কতৃপক্ষ(DTCA)
  • জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি(JICA), ইউনাইটেড ন্যাশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম(UNDP), ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (UNEP), এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক(ADB) এর মত দাতা সংস্থায় কাজের সুযোগ আছে।
  • গবেষণা করতে চাইলে ব্র্যাক, বিভিন্ন পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স(BIP), বেঙ্গল ইন্সটিটিউট ফর আর্কিটেকচার ল্যান্ডস্কেপস এন্ড সেটেলমেন্টস, ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং এ সুযোগ আছে
  • রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গুলোর মধ্যে পিঙ্ক সিটি, শেলটেক, কনকর্ড এর মত বড় বড় কর্পোরেট হাউজে আরবান প্ল্যানার প্রয়োজন হয়।

একজন নগর পরিকল্পনাবিদের মাসিক আয় কেমন?

সাধারণত শুরুটা ১৫,০০০ থেকে শুরু হলেও পেশাগত বৈচিত্র্যের জন্যে পরবর্তীতে দক্ষতা, ডিগ্রী, প্রতিষ্ঠান এবং পারফরমেন্সের ভিত্তিতে আয়ে ব্যাপক তারতম্য দেখা যায়। ২/৩ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে বেতন ৩০-৫০ হাজার টাকা হতে পারে। যেমন বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স এ রিসার্চ এন্ড প্ল্যানিং অফিসারের বেতন ৩০ হাজার টাকা তবে সরকারি বিভিন্ন প্রোজেক্ট কিংবা বিদেশী দাতা সংস্থায় কাজের সুযোগ পেলে মাসে লাখ টাকার অধিক উপার্জন সম্ভব।

ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে একজন নগর পরিকল্পনাবিদের?

নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে কঠোর পরিশ্রমী হওয়া বাঞ্ছনীয়। শুধু আর্থসামাজিক, প্রকৌশল বা বিজ্ঞানভিত্তিক দক্ষতা নয়, সাথে রাজনৈতিক ও আইনি বিষয়ক জটিলতাও পরিকল্পনাবিদদের জন্যে বড় চ্যালেঞ্জ। সার্ভেয়র হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে সাফল্যের শীর্ষে বিদেশী দাতা সংস্থা যেমন এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক কিংবা সরকারি কোন প্রজেক্টের চীফ হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের অনেক নগর পরিকল্পনাবিদ বিদেশে কর্মরত আছে। লিঙ্কডইন এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনাবিদেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত সহ অনেক দেশে কর্মরত আছেন।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা

নাজওয়া তাহসিন, শিক্ষার্থী, আরবান এন্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট’১৩, বুয়েট

Leave a Comment