নিউরোসার্জন

নার্ভ বা স্নায়ুসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন সাধারণত একজন নিউরোলজিস্ট। স্নায়বিক সমস্যার ক্ষেত্রে সার্জারি বা অপারেশন করার প্রয়োজন পড়লে তা একজন নিউরোসার্জনের দায়িত্বের উপর বর্তায়। বাংলাদেশে ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত ব্যক্তি বেশ ভালো পরিমাণেই দেখা যায় এবং সেক্ষেত্রে টিউমার অপসারণের শল্যচিকিৎসা বা সার্জারির কাজ করতে হয় একজন নিউরোসার্জনকে।

একজন নিউরোসার্জন কোথায় কাজ করেন?

সরকারি পর্যায়ে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতাল পর্যন্ত সব ধরনের হাসপাতালেই একজন নিউরোসার্জন কাজ করতে পারেন। সরকারি এবং বেসরকারি – দুই ধরনের হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানেই নিউরোসার্জন নিযুক্ত থাকেন। একজন নিউরোসার্জনের কর্মক্ষেত্র হতে পারে নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে –

১। যে কোন সরকারি ও জাতীয় হাসপাতাল।

২। স্নায়বিক সমস্যার জন্য বিশেষায়িত বেসরকারি হাসপাতাল বা ইন্সটিটিউট ও প্রতিষ্ঠান। যেমন – নিউরোলজি ফাউন্ডেশন ও হাসপাতাল

৩। যে কোন মেডিকেল কলেজ।

৪। জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল।

৫। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

একজন নিউরোসার্জন কী ধরনের কাজ করেন?

নিউরোসার্জন হিসেবে আপনাকে সাধারণত নিম্নলিখিত কাজগুলো করা লাগবে –

১। স্নায়বিক সমস্যার সমাধান হিসেবে সার্জারি বা অপারেশন সম্পন্ন করা।   

২। রক্ত জমে যাওয়ার কারণে স্নায়বিক প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হলে জমে যাওয়া রক্ত সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা। মস্তিষ্কে রক্ত জমে যাওয়ার পরীক্ষা করা যেখানে রক্ত জমে যাওয়ার কারণে স্নায়বিক প্রবাহ সচল থাকতে পারে না। রক্ত জমে যাওয়ার ক্ষেত্রে অপারেশন বা সার্জারি করতে হয় একজন নিউরোসার্জনকে। এক্ষেত্রে সমস্যা নির্ণয় করা নিউরোলজিস্টের কাজ। নির্ণয় করার পরে নিউরোসার্জনের কাছে জমে যাওয়া রক্ত অপসারণ করতে হয় সার্জারির মাধ্যমে।

৩। সার্জারি বা অপারেশনের পরে প্রয়োজনীয় ওষুধ পরামর্শ দেওয়া।  

নিউরোলজিস্ট যদি ব্রেইন টিউমার নির্ণয় করেন পরীক্ষার পরে তাহলে ব্রেইন টিউমারের অপারেশন বা সার্জারি সম্পন্ন করতে হয় একজন নিউরোসার্জনকে।

মেরুদন্ডের সাথে কিছু নার্ভ বা স্নায়ুর সংযোগ থাকে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় মেরুদন্ডের স্নায়ুগুলো সচলভাবে কাজ করছে না মেরুদন্ডের সমস্যা হওয়ায়। এ ধরনের সমস্যা খুঁজে পাওয়া গেলে মেরুদন্ডে প্রয়োজনীয় সার্জারি সম্পন্ন করতে হয় একজন নিউরোসার্জনকে।

শরীরের যে কোন অংশে নার্ভ বা স্নায়ু সংযোগ কেটে গেলে সার্জারি বা শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে তা পুনঃস্থাপন করা।

স্নায়বিক সমস্যা নির্দিষ্ট করতে এমআরআই (MRI – Magnetic Resonance Imaging), স্পেক্ট (SPECT – Single Photo Emission Computed Tomography) ও পেট(PET – Positron Emission Tomography) পরীক্ষাগুলোর রিপোর্ট দেখা এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সার্জারি সম্পন্ন করা।

৮। মস্তিষ্কে স্নায়ু সম্পর্কিত কোন সমস্যা দেখা দিলে সার্জারির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা।

৯। মেরুদন্ডের সমস্যার ক্ষেত্রে সার্জারি প্রয়োজন হলে তা সম্পন্ন করেন একজন নিউরোসার্জন।

একজন নিউরোসার্জনের কী ধরনের যোগ্যতা থাকতে হয়?

এক্ষেত্রে নিউরোলজি বিষয়ে এমএস, এফসিপিএস, এমসিপিএস অথবা ডিপ্লোমা ডিগ্রি থাকলে আপনি নিউরোসার্জন হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন। এ ধরনের এমবিবিএস পরবর্তী কোন ডিগ্রি ছাড়া নিউরোসার্জারি বিষয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জন করা যায় না বিধায় এরকম কোন ডিগ্রি ছাড়া নিউরোসার্জন হিসেবে কোথাও নিয়োগ পাওয়া যায় না। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের মত এখানেও অভিজ্ঞতা থাকলে প্রার্থীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

একজন নিউরোসার্জনের কী ধরনের দক্ষতা ও জ্ঞান থাকতে হয়?

১। ক্যারিয়ার উন্নয়নের জন্য অভিজ্ঞতা চিকিৎসাশাস্ত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভব সরাসরি অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আহরণ করা জরুরি।

২। স্নায়ুর ধরন ও স্নায়ুবিদ্যা নিয়ে গভীর ধারণা থাকতে হবে।

৩। অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড এবং ওষুধ নিয়ে যথার্থ জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

৪। অনেক স্নায়বিক সমস্যা প্রতিরোধ করার জন্যই শক্তিশালী স্টেরয়েডের প্রয়োজন হয়। সার্জারির পরে দ্রুত সেরে ওঠার জন্য কিংবা দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হিসেবে স্টেরয়েড পরামর্শ দেওয়ার আগে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে জেনে নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।

স্নায়বিক রোগের প্রতিকারে প্রতিনিয়ত নতুন সমস্যা যাচাই পরীক্ষার ও ওষুধের আবির্ভাব ঘটে এবং এক্ষেত্রে নিয়মিত জ্ঞান আহরণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার বিষয়।

৬। সার্জারির সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।  

৭। ব্রেন স্ট্রোকের ব্যাপারে যথাযথ জ্ঞান রাখতে হবে কারণ এতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা অনেক।

৮। এমআরআই (MRI – Magnetic Resonance Imaging), স্পেক্ট (SPECT – Single Photo Emission Computed Tomography) ও পেট (PET – Positron Emission Tomography) রিপোর্ট ঠিকমত বুঝতে পারা ও পর্যাপ্ত জ্ঞান ধারণ করা এই রিপোর্টগুলো সম্পর্কে।

৯। ব্রেইন টিউমার এবং মস্তিষ্কে সার্জারির ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি কারণ যে কোন অসতর্কতা রোগীর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

১০। ব্রেইন টিউমার খুবই স্পর্শকাতর একটি রোগ বিধায় এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে যথাযথ জ্ঞান আহরণ করতে হবে এবং সর্বোচ্চ সতর্কতা ও যত্ন নিশ্চিত করতে হবে।

একজন নিউরোসার্জনের মাসিক আয় কেমন?

আপনি যদি একজন নিউরোসার্জন হন সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে মাসিক সম্মানীর পরিমাণ বাংলাদেশে বেশ ভালো। জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে শুরুর দিকে আপনার মাসিক সম্মানী হবে ৬০০০০ টাকা থেকে ৮০০০০ টাকার মত। কিছু সময় অভিজ্ঞতা লাভের পরে মাসিক সম্মানী শুরু হয় এক লাখ টাকা থেকে। সময় ও অভিজ্ঞতার সাথে আপনার মাসিক আয় বেড়ে দুই লাখ টাকা কিংবা তার অধিকও হতে পারে। তবে বিষয়টি কাজ ও প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষ।

সরকারি কর্মক্ষেত্রে আপনার মাসিক সম্মানী নির্দিষ্ট করা থাকবে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ীএক্ষেত্রে আপনার মাসিক সম্মানী শুরু হবে ৬ষ্ঠ স্কেল বা ৪৩০০০ টাকা থেকে।

একজন নিউরোসার্জনের ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে?

যে কোন হাসপাতালের ক্ষেত্রে একজন নিউরোসার্জনের ক্যারিয়ারের পদবিন্যাস সাধারণত নিম্নলিখিত পদগুলো অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে এগোয় –

১। জুনিয়র কনসালট্যান্ট

সিনিয়র কনসালট্যান্ট

এক্ষেত্রে নিয়োগের পরে আপনার প্রথম পদ হবে জুনিয়র কনসালট্যান্টসাধারণত অল্প অভিজ্ঞতা আছে এবং অন্তত একটি ব্যাচেলর পরবর্তী ডিগ্রি আছে এমন ব্যক্তিদেরকে জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে হলে অবশ্যই আপনাকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। কিছু সময় অভিজ্ঞতা লাভের পরে এবং নতুন কোন উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি লাভের মাধ্যমে আপনি সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পাবেন। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের হাসপাতাল এবং জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের ক্ষেত্রেও এই পদবিন্যাস প্রযোজ্য।

মেডিকেল কলেজ, জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউট ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কিংবা যে কোন জায়গায় শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আপনার পদবিন্যাস সহকারী অধ্যাপক থেকে শুরু হয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ অধ্যাপক পর্যন্ত যেতে পারে। নিয়মিত পড়াশোনা করা ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া একজন নিউরোসার্জনের জন্য জরুরী।   

কোথায় পড়বেন নিউরোসার্জারি?

এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের পরে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউরোসার্জারি বিষয়ের উপর ডিপ্লোমা, এমএস, এমসিপিএস এবং অন্যান্য উচ্চশিক্ষার ডিগ্রিগুলো লাভ করা সম্ভব। এছাড়া কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে নিউরোসার্জারি বিষয়ের উপর এই গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী ডিগ্রিগুলো দেওয়া হয়ে থাকে। জাতীয় নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউট থেকেও এই ডিগ্রিগুলো আপনি অর্জন করতে পারবেন। বিসিপিএস বা বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস থেকে নিউরোসার্জারি বিষয়ের উপর এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন একজন এমবিবিএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত চিকিৎসক।  

 

Leave a Comment