একাডেমিয়া-ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপ: কী ও কেন?

বিশ্বায়নের এই যুগে উন্মুক্ত অর্থনৈতিক বাজার, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জোট এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তির মত নতুন নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটায়, শিল্পায়নের উন্নয়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। বিশ্ব এখন শিল্প বিপ্লব থেকে তথ্য বিপ্লব, শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে তথ্যভিত্তিক অর্থনীতির দিকে ধাবিত হয়েছে। যার কারণে বর্তমান চাকুরীর বাজার প্রতিযোগিতাপূর্ণ এবং কঠিন। প্রতিবছর বেশীরভাগ স্নাতক পাসকারী শিক্ষার্থী ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প সেক্টরের দক্ষতা এবং বিশেষজ্ঞতা নির্ভর জনশক্তির চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এর প্রধান কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতিতে ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরের প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং বিশেষজ্ঞতাকে বরাবরই উপেক্ষা করা হয়ে আসছে। কিন্তু  বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরে দক্ষতাভিত্তিক কাজের ব্যাপক চাহিদার কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডাস্ট্রিগুলার যৌথ উদ্যোগের সূচনা ঘটেছে যাকে বলা হচ্ছে একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপ (Academia Industry Partnership)। একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপের মাধ্যমে একদিকে যেমন ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরের প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরি সম্ভব হবে সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইন্ডাস্ট্রি সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারবে।

একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপের জন্য প্রয়োজন সরকার, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত প্রয়াস এবং সহযোগিতা। শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারী বিনিয়োগের উপর নির্ভর করে। একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপ তৈরির ক্ষেত্রে শিল্পভিত্তিক এবং শিল্পায়নের দক্ষতাভিত্তিক গবেষণায় সরকারী বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সাথে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনা জরুরী, যাতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং শিল্পভিত্তিক গবেষণায় বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা এবং পাঠদান পদ্ধতিতে প্রয়োজন ব্যাপক পরিবর্তন যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিল্প খাতের দক্ষতা এবং বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।

একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপের মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি সম্ভব, অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নিশ্চিত করাও সম্ভব।

কেস স্টাডি: ভারত

বিশ্বজুড়ে একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপের উদ্যোগ বিশ্বের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম অর্থনীতির (জিডিপি অনুযায়ী) দেশ ভারতকেও প্রভাবিত করেছে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের সফটওয়্যার এবং অটোমোটিভ সেক্টরে তথ্যভিত্তিক কর্মকাণ্ডে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে ন্যানো প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি ও জৈব প্রযুক্তির উন্নয়ন ভারতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে। বর্তমানে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের বেশিরভাগ বিনিয়োগই ভারতীয় সরকার থেকে করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ভারতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলার সরাসরি বিনিয়োগ এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপের বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে-

১. এইচডিএফসি (HDFC) ব্যাংক অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত গবেষণার লক্ষে ভারতের ৫০টি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং বিজনেস স্কুলের সাথে আইআইটি বম্বে (IIT Bombay) এবং আইআইটি রুর্কী’র (IIT Roorkee) একটি যৌথ প্রোজেক্ট চালু করার ঘোষণা দিয়েছে।

২. একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারতের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় আইআইটি মাদ্রাজের (IIT Madras) গবেষণা খাতের বিনিয়োগ প্রায় ৩০০ কোটি রুপি পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।

৩. ভারতের ইলেক্ট্রনিক সিস্টেম ডিজাইন অ্যান্ড ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রি সেক্টরের উন্নয়নের লক্ষ্যে ইন্ডিয়া ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড সেমিকন্ডাক্টর অ্যাসোসিয়েশান (India Electronics and Semiconductor Association- IESA) আইআইটি খড়গপুরের (IIT Kharagpur) সাথে ৪টি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

৪. সিএ টেকনোলজি (CA Technology) একটি উদ্ভাবনী গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য আইআইটি হায়দ্রাবাদের (IIT Hyderabad) সাথে কাজ করছে।

৫. ভারতে একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপ সমৃদ্ধ করণের লক্ষ্যে ইন্ডিয়ান ইন্সিটিউট অব সায়েন্স (Indian Institute of Science -IISc) জার্মানির টেক জায়ান্ট Bosch এর মত বিশ্বসেরা তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর কোম্পানিগুলোর সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।

তবে ভারতে একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপ সমৃদ্ধ করতে আরও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রয়োজন। এখনো ভারতের টাটা গ্রুপের মতো বড় বড় কিছু কোম্পানি ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণাকেন্দ্র গুলোকে উপেক্ষা করে হার্ভার্ড, ইয়েল এর মতো প্রখ্যাত বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনিয়োগ করছে। যা কিনা ভারতে একাডেমিয়া ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। এছাড়াও ভারতের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফ্যাকাল্টি এবং গবেষণা খাতের উন্নয়নের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (Public-Private Partnership) উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে।

ভারতের মতো একটি শিল্প-প্রযুক্তি নির্ভর দেশে সরকার, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বিত উদ্যোগই পারে ভবিষ্যতে দেশটিকে একটি সমৃদ্ধ এবং  শক্তিশালী প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনীতির দেশে পরিণত করতে। তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির এই যুগে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি সেক্টরে দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প একটি দেশের তথা পুরো বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিস্তৃত ভুমিকা রাখতে পারে।

তথ্যসূত্র

১. Vinay K. Nangia, Cashmira Pramanik (2011), ‘Towards An Integrated Model for Academia-Industry Interface in India’.

২. M.M. Gandhi (2014), ‘Industry-academia collaboration in India: Recent initiatives, issues, challenges, opportunities and strategies’.

৩. ‘India moving towards innovation through academia-industry partnerships’, The Hindustan Times.

৪. ‘Why Leading Institutes In India Are Focusing On Industry Relevant Research?’, Analytics India Magazine.

৫. ‘India is world’s sixth largest economy at $2.6 trillion, says IMF’, The Hindustan Times.

Leave a Comment