কার্ডিয়াক সার্জন

অন্যান্য সকল সমস্যার মত হৃদরোগের সমস্যাও বাংলাদেশে বেশ জটিল হিসেবেই ধরা হয়। রোগ নির্ণয়ের কথা হিসাবে নিলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন কার্ডিওলজিস্টের প্রয়োজনীয়তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও সব ধরনের সমস্যার সমাধান একজন কার্ডিওলজিস্ট দিতে পারেন না। কিছু ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধানের জন্য সার্জারি বা অপারেশনের প্রয়োজন হয় যেখানে কার্ডিয়াক সার্জন সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন।  

একজন কার্ডিয়াক সার্জন কোথায় কাজ করেন?

সরকারি পর্যায়ে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতাল পর্যন্ত সব ধরনের হাসপাতালেই একজন কার্ডিয়াক সার্জন কাজ করতে পারেন। সরকারি এবং বেসরকারি – দুই ধরনের হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানেই কার্ডিয়াক সার্জন নিযুক্ত থাকেন। এটি চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষায়িত একটি অংশ হওয়ায় বেশ অভিজ্ঞতা ও চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষায়িত ডিগ্রি প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে একজন কার্ডিয়াক সার্জনের কর্মক্ষেত্র হতে পারে নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে –

১। যে কোন সরকারি ও জাতীয় হাসপাতাল।

২। হৃদরোগের সমস্যার জন্য বিশেষায়িত বেসরকারি অথবা স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল বা ইন্সটিটিউট ও প্রতিষ্ঠান। যেমন – মহাখালীতে অবস্থিত ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, মিলিনিয়াম হার্ট অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল লিমিটেড, ল্যাবেইড কার্ডিয়াক হসপিটাল, ইবরাহীম কার্ডিয়াক হসপিটাল প্রভৃতি।

৩। যে কোন মেডিকেল কলেজ (সরকারি ও বেসরকারি উভয়)।

৪। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট।

৫। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

একজন কার্ডিয়াক সার্জন কী ধরনের কাজ করেন?

কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে আপনাকে সাধারণত নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে হবে –

১। হৃদযন্ত্রে ও এর আশেপাশে সমস্যা এবং ব্যথা থাকলে সমস্যা ও ব্যথার কারণ নির্ণয় করে দেন কার্ডিওলজিস্ট। সমস্যার সমাধান হিসেবে সার্জারি করার প্রয়োজন হলে আপনাকে একজন কার্ডিয়াক সার্জনের শরণাপন্ন হতে হবে। সেক্ষেত্রে একজন কার্ডিয়াক সার্জন হৃদযন্ত্রের সার্জারি বা অপারেশন সম্পন্ন করে থাকেন।

২। জন্মগত হৃদরোগের চিকিৎসা কার্ডিয়াক সার্জন দিয়ে থাকেন। জন্মগত রোগের ক্ষেত্রে যেহেতু একজন ব্যক্তি হৃদযন্ত্রে ফুটো বা ফাটল অথবা হৃদযন্ত্রের ভালভ নষ্ট নিয়ে জন্ম নিয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে একজন কার্ডিওলজিস্টের পক্ষে এই সমস্যার সমাধান দেওয়া সম্ভব নয় যেহেতু ওষুধ বা স্টেন্টিং-এর মাধ্যমে এই ব্যাপারে প্রতিকার পাওয়ার কোন উপায় নেই। এক্ষেত্রে আপনাকে হৃদযন্ত্রের ভেতর শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অঙ্গ বা অংশ প্রতিস্থাপন ছাড়া প্রতিকার পাওয়া যাবে না।

৩। কনজেনিটাল বা জন্মগত হৃদযন্ত্রের সমস্যা হলে তা নির্ণয় করে দেন একজন কার্ডিওলজিস্ট। জন্মগত সমস্যার সমাধান করেন কার্ডিয়াক সার্জন অপারেশন সম্পন্ন করার মাধ্যমে।   

৪। হৃদযন্ত্রের ভালভ নষ্ট হলে তা অপারেশন বা সার্জারির মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করতে হয় একজন কার্ডিয়াক সার্জনকে।

৫। যদি আপনার হৃদযন্ত্রে ব্লক বা রক্তপ্রবাহে বাধা নির্ণয় করা হয় সেক্ষেত্রে হৃদযন্ত্রে স্টেন্টিং-এর কাজ সম্পন্ন করতে হয় একজন কার্ডিওলজিস্টকে। প্রচলিত বাংলা ভাষায় স্টেন্টিংকে রিং পড়ানো বলা হলেও চিকিৎসাশাস্ত্রের পরিভাষায় রিং পড়ানো বলতে কিছু নেই, বরং স্টেন্টিং নামেই তা পরিচিত। স্টেন্টিং-এর খরচ অনেক বেশি পড়ে বিধায় সকলের স্টেন্টিং সম্পন্ন করানোর সামর্থ্য নেই। তাই অনেক ক্ষেত্রেই হার্ট বা হৃদযন্ত্রে সার্জারির জন্য আগ্রহী হতে দেখা যায় রোগীদের।

৬। যদি কেউ হৃদরোগে স্টেন্টিং না পড়িয়ে সার্জারি করানোর মাধ্যমে ব্লকের সমাধান করতে চান সেক্ষেত্রে কার্ডিওলজিস্ট তা সম্পন্ন করতে পারবেন না বরং একজন কার্ডিয়াক সার্জন তা সম্পন্ন করবেন। তবে রোগ ও সমস্যা নির্ণয়ের কাজ একজন কার্ডিওলজিস্টকেই সম্পন্ন করতে হয়। কার্ডিয়াক সার্জন শুধুমাত্র সার্জারি ও অপারেশনের কাজ সম্পন্ন করেন। এক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে বাইপাস বা নতুন পথের সৃষ্টি করা হয় হৃদযন্ত্রে রক্ত প্রবাহের জন্য।

৭। সার্জারি সম্পন্ন হওয়ার পরে একজন রোগীকে প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও ওষুধ নিয়ে পরামর্শ দিতে হয় একজন কার্ডিয়াক সার্জনকে। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যাতে আর কোন সমস্যা দেখা না যায় হৃদযন্ত্রে রক্ত প্রবাহের বিষয়ে তা নিশ্চিত করতে কী ধরনের ওষুধ খেতে হবে এবং কোন্‌ কাজের ক্ষেত্রে কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলতে হয় একজন কার্ডিয়াক সার্জনকে।

একজন কার্ডিয়াক সার্জনের কী ধরনের যোগ্যতা থাকতে হয়?

শুধুমাত্র এমবিবিএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত হলেই কার্ডিয়াক সার্জন হওয়া যায় না। বরং কার্ডিয়াক সার্জারি বিষয়ের উপর বিশেষায়িত ডিগ্রি থাকলেই কেবলমাত্র আপনি কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে কাজ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে কার্ডিয়াক সার্জারি বিষয়ে এমএস, এফসিপিএস, এমসিপিএস অথবা ডিপ্লোমা ডিগ্রি থাকলে আপনি কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন। এ ধরনের এমবিবিএস পরবর্তী কোন ডিগ্রি ছাড়া কার্ডিয়াক সার্জারি বিষয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জন করা যায় না বিধায় এরকম কোন ডিগ্রি ছাড়া কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে কোথাও নিয়োগ পাওয়া যায় না। নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত পূর্ব অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের মত এখানেও অভিজ্ঞতা থাকলে প্রার্থীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

একজন কার্ডিয়াক সার্জনের কী ধরনের দক্ষতা ও জ্ঞান থাকতে হয়?

১। নিয়োগের পরবর্তী জীবনে ক্যারিয়ার উন্নয়নের জন্য অভিজ্ঞতা চিকিৎসাশাস্ত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভব সরাসরি অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আহরণ করা জরুরি।

২। কনজেনিটাল ও স্ট্রাকচারাল (জন্মগত ও কাঠামোগত) হৃদরোগ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।

৩। ইকো, ইসিজি, অ্যাঞ্জিওগ্রাম, লিপিড টেস্ট প্রভৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে ভালোমত জানতে হবে এবং রিপোর্ট বোঝার মত যথাযথ জ্ঞান থাকতে হয়।   

৪। সার্জারির কাজ বেশ স্পর্শকাতর এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় খুব দক্ষ ও পারদর্শী না হলে সাধারণত কেউ অপারেশনের কাজের দিকে আগ্রহী হন না। সেক্ষেত্রে অনেক বেশি দক্ষতা না থাকলে সার্জারি সম্পন্ন করার ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়।

৫। হৃদযন্ত্রের ধরন নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।

৬। সার্জারির কাজ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অপারেশন সম্পন্ন করার সময় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

একজন কার্ডিয়াক সার্জনের মাসিক আয় কেমন?

আপনি যদি একজন কার্ডিয়াক সার্জন হন সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে মাসিক সম্মানীর পরিমাণ বাংলাদেশে বেশ ভালো। বেসরকারি ক্ষেত্রে শুরুর দিকে আপনার মাসিক সম্মানী শুরু হবে দেড় লাখ টাকা থেকে। সময় ও অভিজ্ঞতার সাথে আপনার মাসিক আয় বেড়ে দুই লাখ টাকা কিংবা তার অধিকও হতে পারে। তবে বিষয়টি কাজ ও প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষ।

সরকারি কর্মক্ষেত্রে আপনার মাসিক সম্মানী নির্দিষ্ট করা থাকবে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী। এক্ষেত্রে আপনার মাসিক সম্মানী শুরু হবে ৬ষ্ঠ স্কেল বা ৪৩০০০ টাকা থেকে।

কোথায় পড়বেন কার্ডিয়াক সার্জারি?

এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের পরে বাংলাদেশে বিসিপিএস (বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস) থেকে কার্ডিয়াক সার্জারি বিষয়ের উপর এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করা সম্ভব। এছাড়া কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কার্ডিয়াক সার্জারি বিষয়ের উপর এই গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী ডিগ্রিগুলো, যেমন – ডিপ্লোমা, এমএস প্রভৃতি দেওয়া হয়ে থাকে। জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট কিংবা ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন থেকেও আপনি কার্ডিয়াক সার্জারি বিষয়ে ডিগ্রি নিতে পারেন।

একজন কার্ডিয়াক সার্জনের ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে?

যে কোন হাসপাতালের ক্ষেত্রে একজন কার্ডিয়াক সার্জনের ক্যারিয়ারের পদবিন্যাস সাধারণত নিম্নলিখিত পদগুলো অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে এগোয় –

১। জুনিয়র কনসালট্যান্ট

২। সিনিয়র কনসালট্যান্ট

এক্ষেত্রে নিয়োগের পরে আপনার প্রথম পদ হবে জুনিয়র কনসালট্যান্ট। সাধারণত অল্প অভিজ্ঞতা আছে এবং অন্তত একটি ব্যাচেলর পরবর্তী ডিগ্রি আছে এমন ব্যক্তিদেরকে জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে হলে অবশ্যই আপনাকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। কিছু সময় অভিজ্ঞতা লাভের পরে এবং নতুন কোন উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি লাভের মাধ্যমে আপনি সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পাবেন। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের হাসপাতালের জন্যই তা প্রযোজ্য।

মেডিকেল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কিংবা যে কোন জায়গায় শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আপনার পদবিন্যাস সহকারী অধ্যাপক থেকে শুরু হয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ অধ্যাপক পর্যন্ত যেতে পারে। নিয়মিত পড়াশোনা করা ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া একজন কার্ডিয়াক সার্জনের জন্য জরুরী।   

Leave a Comment