ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ

মরণাপন্ন বা সংকটাপন্ন অবস্থার রোগীদের চিকিৎসার জন্য বর্তমানে আলাদা ধরনের বিশেষজ্ঞ থাকেন যাদেরকে বলা হয় ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ। সাধারণত খুব জটিল অবস্থায় কিংবা লাইফ সাপোর্টে বাঁচিয়ে রাখা হবে এমন ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে অন্য সব ধরনের বিশেষজ্ঞ থেকে ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের কাজ বেশ আলাদা এবং সাধারণত সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকাকালীন তাকে চিকিৎসা প্রদান করতে হয়।

একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ কোথায় কাজ করেন?

টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ কাজ করে থাকেন। সরকারি এবং বেসরকারি – দুই ধরনের হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানেই ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত থাকেন। এটি চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষায়িত একটি অংশ হওয়ায় বেশ অভিজ্ঞতা ও চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষায়িত ডিগ্রি প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ কর্মক্ষেত্র হতে পারে নিম্নলিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে –

১। টারশিয়ারি পর্যায়ের সরকারি ও জাতীয় হাসপাতাল (অর্থাৎ যেখানে আইসিইউ বা নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিট আছে)।

২। কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ।

৩। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

৪। বড় ধরনের বেসরকারি হাসপাতাল যেখানে আইসিইউ বা নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিট আছে।

একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ কী ধরনের কাজ করেন?

ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনাকে সাধারণত নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে হবে –

১। সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন এমন রোগীর চিকিৎসা করা।

২। লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজন আছে কিনা তা নির্ণয় করা এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় কোন বিশেষ সমস্যা আছে কিনা তা নির্ণয় করা।

৩। রোগীকে সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ পরামর্শ দেওয়া ও দেখভাল করা।

৪। জীবননাশী আঘাত এবং ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তির চিকিৎসা করা ও সমস্যার যথাসম্ভব সমাধান পরামর্শ দেওয়া।

৫। আইসিইউতে ভর্তি হন এমন ব্যক্তিরা সাধারণত কিছু পরিচিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এ পরিচিত রোগগুলো হতে পারে – এআরডিএস (ARDS – Acute Respiratory Distress Syndrome), সেপসিস, মাল্টিপল অরগান ফেইলার (অর্থাৎ একইসাথে শরীরের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশের ও অঙ্গের অচল হয়ে পড়া) প্রভৃতি। এই সমস্যাগুলোর যথাসম্ভব তাৎক্ষণিক সমাধানের চেষ্টা করতে হয় একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞকে।

৬। যে কোন ধরনের প্রয়োজনীয় আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিম সহায়তা ও সাপোর্ট প্রদান করতে হয় একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞকে।

৭। কৃত্রিম সহায়তার মাধ্যমে রোগীর সংকটাপন্ন অবস্থাকে প্রশমন করতে হয়।   

একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের কী ধরনের যোগ্যতা থাকতে হয়?

ক্রিটিকাল কেয়ার বিষয়ের উপর বিশেষায়িত ডিগ্রি থাকলেই কেবলমাত্র আপনি ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে ক্রিটিকাল কেয়ার বিষয়ে এমডি, এফসিপিএস, এমসিপিএস অথবা ডিপ্লোমা ডিগ্রি থাকলে আপনি ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ পেতে পারেন। এ ধরনের এমবিবিএস পরবর্তী কোন ডিগ্রি ছাড়া ক্রিটিকাল কেয়ার বিষয়ে বিশেষায়িত জ্ঞান অর্জন করা যায় না বিধায় এরকম কোন ডিগ্রি ছাড়া ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কোথাও নিয়োগ পাওয়া যায় না। নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত পূর্ব অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের মত এখানেও অভিজ্ঞতা থাকলে প্রার্থীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের কী ধরনের দক্ষতা ও জ্ঞান থাকতে হয়?

১। নিয়োগের পরবর্তী জীবনে ক্যারিয়ার উন্নয়নের জন্য অভিজ্ঞতা চিকিৎসাশাস্ত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভব সরাসরি অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আহরণ করা জরুরি। ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের জন্য নিয়োগের আগে থেকেই যথাসম্ভব অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে হয়। চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যান্য বিভাগ থেকে ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিন বিষয়টি বেশি স্পর্শকাতর কারণ সংকটাপন্ন রোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি চ্যালেঞ্জিং এবং জটিল বিষয়।

২। আইসিইউতে যেহেতু সংকটাপন্ন রোগীরা সাধারণত ভর্তি থাকেন সেক্ষেত্রে ইউনিটের ভেতরে যাতে কোন ধরনের হট্টগোল কিংবা ভিড় সৃষ্টি না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞকে।

৩। আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিম সহায়তার ব্যাপারে যথাযথ দক্ষতা ও জ্ঞান থাকতে হবে।

৪। একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞকে সাধারণত মাল্টিপল অরগান ফেইলারসহ আরও বেশ কিছু জটিল সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হয়। সেক্ষেত্রে ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনাকে বিভিন্ন অঙ্গের বিভিন্ন জটিল ও তীব্র সংকট সৃষ্টিকারী সমস্যাগুলো সম্পর্কে ভালোমত জানত হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় – একজন কার্ডিওলজিস্ট যেমন শুধুমাত্র হৃদযন্ত্রের সমস্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন ও চিকিৎসা করেন কিংবা একজন হেপাটোলজিস্ট যেমন শুধুমাত্র যকৃত ও বৃহদান্ত্রের উপর বিশেষ দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করেন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রে তেমন কোন বিশেষ অঙ্গ নেই। বরং সকল অঙ্গের জটিল সমস্যা যা ব্যক্তিকে সংকটাপন্ন অবস্থায় আনয়ন করে সেগুলো সম্পর্কে একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞকে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে হয়।

৫। বৃক্ক বা কিডনী, হৃদযন্ত্র, ফুসফুস, লিভার বা যকৃতের সমস্যা নিয়ে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। এ অঙ্গগুলোতে সৃষ্ট কোন্‌ সমস্যাগুলো পরবর্তীতে জটিল আকার ধারণ করতে পারে সেগুলো নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।

৬। আইসিইউ-এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র এবং কৃত্রিম সহায়তা প্রদানের জন্য রোগীর অবস্থা কখন প্রযোজ্য হবে সে ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।

৭। এছাড়া মানবদেহের অন্যান্য জরুরি এবং অপরিহার্য অঙ্গগুলোর জটিল সমস্যা নিয়ে জানতে হবে।  

একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের মাসিক আয় কেমন?

আপনি যদি একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ হন সেক্ষেত্রে বেসরকারি ক্ষেত্রে জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে শুরুর দিকে আপনার মাসিক সম্মানী শুরু হতে পারে সাধারণত ৪০০০০ টাকা থেকে। সময় ও অভিজ্ঞতার সাথে আপনার মাসিক আয় বেড়ে এক লাখ টাকা কিংবা তার অধিকও হতে পারে। তবে বিষয়টি কাজ ও প্রতিষ্ঠানসাপেক্ষ।

সরকারি কর্মক্ষেত্রে আপনার মাসিক সম্মানী নির্দিষ্ট করা থাকবে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী। এক্ষেত্রে আপনার মাসিক সম্মানী শুরু হবে ৬ষ্ঠ স্কেল বা ৪৩০০০ টাকা থেকে।

একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে?

হাসপাতালের ক্ষেত্রে একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের ক্যারিয়ারের পদবিন্যাস সাধারণত নিম্নলিখিত পদগুলো অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে এগোয় –

১। জুনিয়র কনসালট্যান্ট

২। সিনিয়র কনসালট্যান্ট

এক্ষেত্রে নিয়োগের পরে আপনার প্রথম পদ হবে জুনিয়র কনসালট্যান্ট। সাধারণত অল্প অভিজ্ঞতা আছে এবং অন্তত একটি ব্যাচেলর পরবর্তী ডিগ্রি আছে এমন ব্যক্তিদেরকে জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জুনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করতে হলে অবশ্যই আপনাকে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। কিছু সময় অভিজ্ঞতা লাভের পরে এবং নতুন কোন উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি লাভের মাধ্যমে আপনি সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পাবেন। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের হাসপাতালের জন্যই তা প্রযোজ্য।

মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কিংবা যে কোন জায়গায় শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আপনার পদবিন্যাস সহকারী অধ্যাপক থেকে শুরু হয়ে সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ অধ্যাপক পর্যন্ত যেতে পারে। নিয়মিত পড়াশোনা করা ও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া একজন ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের জন্য জরুরী।   

কোথায় পড়বেন ক্রিটিকাল কেয়ার?

এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের পরে বাংলাদেশে বিসিপিএস (বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস) থেকে ক্রিটিকাল কেয়ার বিষয়ের উপর এফসিপিএস ডিগ্রি লাভ করা সম্ভব। এছাড়া কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রিটিকাল কেয়ার বিষয়ের উপর গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী ডিগ্রিগুলো যেমন – ডিপ্লোমা, এমডি প্রভৃতি দেওয়া হয়ে থাকে।

 

Leave a Comment