একজন বায়োউদ্যোক্তা হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা

কিছু ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে শুরু করা যাক।

অতীতের অনুভূতি সহজে হারিয়ে যায় না। স্কুলে লুকিয়ে লুকিয়ে তিন গোয়েন্দা পড়ার সময়, বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের রোমাঞ্চকর গল্পগুলোতে, আমি এক নীল অসীমে হারিয়ে যেতাম। শহর-জীবনের গৎবাঁধা রুটিনের সীমাবদ্ধতায় বইগুলো ছিলো নেশা – সুবিশাল এ দুনিয়ায় “হারিয়ে যাবার নেই মানা মনে মনে” ধরনের অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম।

২০০৯ সালের দিকে আব্বুর সাথে কথা হচ্ছে।

কী হবা? ডাক্তার?

– জানি না। আচ্ছা, একজন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কী করবো? তার চেয়ে ব্যবসা করি। আরো দশজন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারকে চাকরি দেয়া যাবে। এমনকি কোম্পানির টাকায় হয়তো আরো দশজন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানানো যাবে।

২০১০ সালের শুরুর কথা। আইবিএর (IBA) জাওয়াদ আঙ্কেলের (ডঃ জাওয়াদুর রহিম জাহিদ) রুম।

– আঙ্কেল, আমি খুব অস্থিরতায় ভুগি কিছু করার জন্য। জীবনে চাকরি করবো না। কিছু গড়তে চাই।

স্বপ্ন তো সবাই দেখে। কিন্তু যাই করো, বয়স থাকতে করে ফেলো। ত্রিশের আগে দায়দায়িত্ব আসার আগে।

দুই বছর আগেই শুনেছি মাইক্রোবায়োলজি পড়ে কী করবে? দেশের ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চাকরি করবে। মানুষের মল-মূত্র পরীক্ষা করবে। এর বেশি কী করবে? বেশি হলে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিচার হবে। কপাল ভালো হলে ফার্মা কোম্পানিগুলোতে চাকরি হবে। ব্যাংকে চেষ্টা করো। কিংবা মাস্টার্স করে বিসিএস দাও।

কে শোনে কার কথা!

বায়োউদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন

পাশের দেশ ভারতের প্রথম বায়োটেক উদ্যোক্তা কিরণ মজুমদার। সাধারণ একজন মানুষ থেকে বিশ্বের অন্যতম বড় বায়োটেক কোম্পানি বায়োকনের মালিক হয়েছেন তিনি! একবিংশ শতাব্দীতে বায়োটেকের জয়যাত্রার সময় বায়োইকোনমি হবার সুবর্ণ সুযোগ আছে বাংলাদেশেরও। অন্যদিকে ফিউচারিস্ট রে কুর্জওয়েলের মতে কোয়ান্টাম ফিজিক্স, ন্যানোটেক, আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজিন্স আর বায়োটেকের মতো এক্সপোনেনশিয়াল টেকনোলজি মানব সভ্যতাকে সিঙ্গুলারিটির দিকে নিয়ে যাবে; “Playing God”-এর মতো সিনবায়োর উপর বিবিসি ডকুমেন্টারি — এ ধরনের খবর, লেখা আর ভিডিও দেখে তখন আমি রীতিমতো উজ্জীবিত! সবার কথায় কান দেবার সময় কোথায়? বায়োটেক উদ্যোক্তাই হবো।

ব্যাঙ্গালোরে আন্ডারগ্র্যাড পড়ি তখন। সময়-সুযোগ পেলে বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রির খবরগুলো ফলো করি একটু একটু করে। কিন্তু দেশের বায়োটেকের কোন তথ্য-উপাত্ত পাই না তেমন কোথাও। খারাপ লাগে কিছুটা।

ভারতে বেশ কয়েকটা বায়োটেক কোম্পানি আছে। পাশ্চাত্যের মতো বিশাল ইন্ডাস্ট্রি না হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় তারা রীতিমতো দাপটের সাথে এগিয়ে চলছে। অথচ বাংলাদেশে একটা বায়োটেক কোম্পানিও গড়ে ওঠেনি। নামকাওয়াস্তে যেগুলো আছে, সেগুলো সম্পর্কে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখি এরা এখনো ওয়েবসাইট সর্বস্ব। টুকটাক বায়োইনফরমেটিক্স সার্ভিস বা বায়োটেক ইকুইপমেন্টস সরবরাহ করে – এই যা।

ইন্সেপ্টার (Incepta) বায়োটেক ডিভিশনের কথা ইদানিং জেনেছি। নিঃসন্দেহে ভালো খবর। কিন্ত ডেডিকেটেড বায়োটেক কোম্পানি আছে কি? লাল তীর নামে একটা প্রতিষ্ঠানের কথা শুনলাম কিছুটা। ওরা কৃষি নিয়ে কাজ করে। কিন্তু পাটের জিনোম সিকোয়েন্সে বায়োইনফরমেটিক্সের কাজে কি তারা জড়িত ছিলো? ঠিক মনে নেই কী পড়েছিলাম। একটা উপসংহার টানা যায়। সম্পূর্ণ বায়োটেকভিত্তিক কোম্পানি তখনো ছিলো না দেশে।

আমার প্রশ্নগুলো সহজ ছিলো। দেশে বায়োটেক বলতে ছাত্ররা কেন কেবল গবেষক হতে চায় বা গবেষণা করতে চায়? সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা আনুদান দিয়ে বায়োটেকের আর কতটুকু করবে? কোম্পানি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিম্বায়োসিস ছাড়া বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে গড়ে উঠবে? দামী লাইফ সায়েন্সে পড়ে বিদেশ ছাড়া কোথায় গবেষণা করবেন আপনি? দেশের বায়োটেকের কী হবে? আমি আরেকজনের বায়োটেক কোম্পানিতে চাকরি করে ঐ দেশের ঐ কোম্পানির মালিকের স্বপ্ন সার্থক করে জীবন শেষ করবো?

Stay foolish. Stay hungry.

আজ এখানে দাঁড়িয়ে চার বছর আগের ব্যাঙ্গালোরের নিজেকে দেখি। বায়োটেক উদ্যোক্তাই হবো আমি।

এগিয়ে যাবার চেষ্টা

২০১৩ সালে ইন্টারনেট ঘেঁটে একটা পিডিএফ নামালাম –  “The Entrepreneur’s Guide to a Biotech. Startup”, পিটার কোলচিনস্কির লেখা। খুব সুন্দর করে বাঁধাই করে একদম মলাট লাগিয়ে কী হুলুস্থুল অবস্থা! কিন্তু বইটা বারবার পড়ার চেষ্টা করেও কয়েক পাতার বেশি এগোতে পারি নি। হয় মাথার উপর দিয়ে গেছে অথবা ঘুমিয়ে পড়ি।

বিএসসি শেষ হয় ঐ বছর। দুনিয়াতে তখন মাত্র দুই-তিন জায়গায় বায়োউদ্যোগের উপর মাস্টার্স করায় – সুইডেনের ক্যারোলিনিস্কা ইন্সটিউটে আর ক্যামব্রিজের এমফিল ইন বায়ো এন্টারপ্রাইজ। অন্য কয়েকটা প্রতিষ্ঠানে সীমিত আকারে করাতো। কিন্তু সেগুলো মূলত ছিলো এমবিএ বা বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রির কিছু কোর্স। একটা ব্যাপার উপলব্ধি করলাম। গবেষণানির্ভর এ ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে হলে আমারও গবেষণায় অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।

২০১৪ সাল। প্যারিসে সিনবায়ো প্রোগ্রামে আবেদন করার সময় স্টেটমেন্ট অব পারপাসে লিখলাম দেশে বায়োটেক উদ্যোক্তা হবার স্বপ্নের কথা। স্কাইপের ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাসা করলো রিসার্চ মাস্টার্স শেষ করে কী করতে চাই। উত্তরের কোন পরিবর্তন হলো না – দশ বছর নিজেকে একজন বায়োউদ্যোক্তা হিসাবে দেখতে চাই।

পিটার কোলচিনস্কির না পড়া বইটা নিয়েই প্যারিসে চলে গেলাম।

সিন্থ্যাটিক বায়োলজিতে পদার্পণ

২০১৫ সালের জানুয়ারি। পাস্তুর ইন্সটিউটে ড. ড্যাভিড বিকার্ডের সিনবায়ো ল্যাবে মাস্টার্সের প্রথম ইন্টার্নশিপ করছি তখন। সেখানকার নেটওয়ার্কে রেজিস্টার্ড করানো থাকায় সমস্ত সায়েন্স জার্নালে ফ্রি এক্সেস ছিলো। অবসরে বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রি আর উদ্যোগ নিয়ে পড়তাম জার্নালগুলোতে। এর মধ্যে নেচারের (Nature) বায়োএন্ট্রাপ্রেনার সিরিজ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এত নেশায় ধরে গিয়েছিলো যে ১৯৯৮ সালের পুরানো লেখাগুলো পর্যন্ত ডাউনলোড করে ফেললাম। এক এক করে পড়ে ফেলেছি সব!

২০১৪ বা ২০১৫ সালের আগেও আমি আইজেম (iGEM) বা সিন্থ্যাটিক বায়োলজি নিয়ে বেশি কিছু জানতাম না। প্রথম ইন্টার্নশিপ সিনবায়োতে শেষ করে সিদ্ধান্ত নিলাম দ্বিতীয় ইন্টার্নশিপ আইজেমেই করবো।

প্যারিসের আইজেম বেতেনকোর্ট ২০১৫ দলের সাথে “Ferment it Yourself” প্রজেক্টে কাজ করলাম। বোস্টনে আইজেম জাম্বুরিতে গোল্ড জিতলাম আমরা।

জীবনে কঠিন সময় পার করতে হয় প্রায় সবাইকেই। ২০১৫ সালের শেষ আর ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে বিষণ্ণতা, হতাশা আর একাকিত্ব আমাকে ধরাশায়ী করে দিয়েছিলো। বন্ধু মহলে ইতিবাচক হিসাবে আমার পরিচয় আছে। কিন্তু সে সময় প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম।

সাইকিয়াট্রিস্টের চিকিৎসা নিয়েছি দুই মাস। খুব লাভ হয় নি। তাই আর যাই নি। বরং নিজেকে ঠিক করেছি একটু একটু করে। কে জানি বলেছিলো, জীবন তোমাকে নিঃস্ব করে দেবার পর যা বেঁচে থাকে তোমার কাছে, তুমি তাই। স্বপ্ন আর সাহস ছিলো বাকি শুধু।

ইউনিবায়োমকে বাস্তবতায় আনা

আবার ফিরে যাই আইজেমের পর্বে।

বেশিরভাগ টিমমেট প্রজেক্টের পর নিজেদের অন্যান্য ইন্টার্নশিপ বা পিএইচডি থিসিস নিয়ে মগ্ন হয়ে যায়। এ দারুণ প্রজেক্টে লেগে থাকার আগ্রহ কেউ দেখায়নি। আমি ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম আবার। খুঁজে পেলাম, এ প্রজেক্টের আইডিয়া ভিশন একেবারে নতুন। যদি একটা ব্যবসায়িক ধারণা দাঁড় করানো যায়, তাহলে কিছু হয়ে যেতে পারে। সুইজারল্যান্ডের জুরিখে থট ফর ফুড চ্যালেঞ্জে অংশগ্রহণ করলাম আরো ৪ জন বন্ধু সহ। লেগে থাকার ফলাফল মিললো – কার্শ্নার ফুড ফেলো অ্যাওয়ার্ড জিতলাম!

স্টার্ট আপ এক্সেলারেটর প্রোগ্রাম অনেক আছে দুনিয়া জুড়ে। এরা ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট হয়ে থাকে। দুনিয়ার যাবতীয় বড় আইডিয়াগুলোর উপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো স্টার্টআপগুলোকে এরা অর্থ, ব্যবসায়িক, লিগাল মেন্টরিং ও নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে বাস্তবিক কোম্পানিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। বিনিময়ে কোম্পানির কিছু মালিকানা তাদের দিতে হয়। সিড লেভেল বা সিরিজ এ বা বি লেভেলে এ ফান্ডিং করে থাকে তারা।

সিন্থ্যাটিক বায়োলজি আর বায়োটেকে বিশ্বের সর্বপ্রথম বায়োটেক স্টার্টাপ এক্সেলারেটর হচ্ছে ইন্ডিবায়ো ইইউ। আমাদের বায়োটেক স্টার্টআপ ২০১৬ সালের ইন্ডিবায়ো ইউ ব্যাচের জন্য নির্বাচিত হয়ে গিয়েছে। তারা বিনিয়োগ করছে ১ লাখ ডলার, ৮% ইকুইটির বিনিময়ে। ৫০ হাজার ক্যাশ আর ৫০ হাজার তিন মাসের আয়ারল্যান্ডের কোর্ক শহরে ট্রেনিং প্রোগ্রামের খরচ। কোম্পানির ভ্যালুয়েশান ১+মিলিয়ন ডলার। কোফাউন্ডার হিসাবে কোম্পানির অপারেশন্স লিড আমি। কোম্পানির নাম “ইউনিবায়োম”।

বায়োটেকে ব্যবসা খুব কঠিন। বায়োটেকে “স্টার্ট আপ” কথাটা খুব যায় না। এর প্রফিট ৫ থেকে ১০ বছর পর দেখা যায়। স্টার্টআপে ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা খুব বেশি – দশটায় নয়টা স্টার্টআপ ব্যর্থ হয়। বায়োটেকে এ ঝুঁকি তো আরো বেশি! এর গবেষণায় অকল্পনীয় পরিমাণ অর্থ খরচ হয়। কিন্তু এ যাত্রা আমাকে প্রতিনিয়ত কিছু শিখিয়েছে।

বাংলাদেশে বায়োটেক শিল্প নেই। নেই সরকারি কোন উদ্যোগ। আবার শিক্ষা বা গবেষণা নীতিতেও সে প্রাধান্য নেই। প্রাইভেট সেক্টরেও নেই কোন চেষ্টা।, শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের দূরদর্শিতার অভাব আছে। অন্যদিকে সমাজ আর পরিবারগুলোতে স্বপ্ন দেখার সৎ সাহস ছিলো খুব কম সময়েই। এত না থাকার মাঝেও পরিবর্তন শুরু হয় একটু একটু করে।

বাংলাদেশে বায়োটেক স্টার্টআপ করতে পারিনি বা করার অবস্থা আসেনি। কিন্তু একদিন প্রথম বাংলাদেশি বায়োউদ্যোক্তাদের প্রজন্ম হিসেবে দেশে বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রি আরো অনেকের সাথে রয়ে গেলো।

1 thought on “একজন বায়োউদ্যোক্তা হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা”

Leave a Comment