ব্যবসার জন্য পুঁজি কোথায় পেতে পারেন?

নতুন ব্যবসা কিংবা কোন উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে পুঁজি বা ফান্ডিং জোগাড় করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে অনেক সম্ভাবনাময় উদ্যোগই আলোর মুখ দেখতে পারে না প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে। এক্ষেত্রে যেকোনো ধরণের ব্যবসা বা উদ্যোগ গ্রহণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট খাতে পুঁজি বা ফান্ডিং জোগাড় করার উপায়গুলো সম্পর্কে জানতে হবে। নতুন কোন উদ্যোগের স্টার্টআপ বা চলমান কোন ব্যবসায় পুঁজি বা ফান্ডিং জোগাড় করার জন্য রয়েছে বেশ কিছু জনপ্রিয় ও কার্যকরী পন্থা-

০১. ব্যাংক ঋণ

ছোট এবং মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় পুঁজি যোগাড় করার ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। বিভিন্ন ব্যাংক বিভিন্ন মেয়াদে, বৈশিষ্ট্যে এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধায় ঋণ দিয়ে থাকে। নিজের ব্যবসার ধরণ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংক ঋণ খুঁজে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু ভাল আইডিয়া থাকলেই ব্যাংক ঋণ পাওয়া যায় না। বরং ব্যাংক ঋণ পেতে কোম্পানির ভাল ট্র্যাক রেকর্ড এবং ভাল ক্রেডিট থাকা জরুরী। কোন স্টার্টআপ ব্যবসার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের ব্যক্তিগত গ্যারান্টির দরকার পরে। ব্যাংক ঋণ সাধারণত দুই ধরণের হয়- ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোন এবং ফান্ডিং। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোনের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে লাভের মুখ দেখেছে এমন উদ্যোগকে বাছাই করা হয়। অন্যদিকে ফান্ডিং এর ক্ষেত্রে নতুন কিন্তু বাস্তবসম্মত এবং সম্ভাবনাময় ব্যবসায়িক পরিকল্পনাসম্বলিত প্রোজেক্টগুলোকে বাছাই করা হয়।

০২. সরকারি স্টার্টআপ ফান্ডিং

বেশ কয়েকবছর ধরেই বাংলাদেশে স্টার্টআপ কালচার শুরু হয়েছে। স্টার্টআপ উদ্যোগ সমূহের জন্য সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বেশ কিছু ফান্ডিং প্রোজেক্ট হয়েছে। এ ধরণের ফান্ডিং এর আওতায় সরকার বিভিন্ন মেয়াদে নতুন আইডিয়া সম্বলিত স্টার্টআপ উদ্যোগ সমুহে বিনিয়োগ করে থাকে। এসব ফান্ডিং পেতে বেশ কিছু স্ক্রিনিং প্রসেস পার করতে হয়। আমাদের দেশে সরকারপ্রদত্ত স্টার্টআপ ফান্ডিংগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ইনোভেশন সার্ভিস ফান্ড, ইনোভেশন ফান্ড, আইসিটি ডিভিশন ফান্ড, স্টার্টআপ বাংলাদেশ ইত্যাদি।

০৩. ভেঞ্চার ক্যাপিটাল

ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড বা তহবিল সাধারণত কোন ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম বা কোম্পানি দ্বারা গঠিত হয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসম্বলিত (যেমন আইটি, আইটিইএস, বায়োমেডিক্যাল ইত্যাদি) তহবিল যেখানে বড় বড় প্রতিষ্ঠান কিংবা বিত্তশালীরা দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করেন। একটি ভেঞ্চার ফান্ডের সময়কাল সাধারণত ৫-১৫ বছর হয়ে থাকে। এই পুরো তহবিলের দেখা শোনা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম করে থাকে যার বিনিময়ে তারা ব্যবস্থাপনা ফি নিয়ে থাকে। ভেঞ্চার ফান্ডে যারা বিনিয়োগ করেন তাদের লিমিটেড পার্টনার বা এলপি বলা হয়। অন্যদিকে যারা এই ফান্ড ব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগ করে থাকে তাদের জেনারেল পার্টনার বা জিপি বলে। ভেঞ্চার ফান্ড থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে বিনিয়োগের ব্যাপারটি ভেঞ্চার ফার্ম নিয়ন্ত্রণ করে। বিনিয়োগ সাধারণত দীর্ঘমেয়াদের হয় (৩ থেকে ৮ বছর)। বিনিয়োগ প্রধানত সাধারণ শেয়ার ও আংশিক পুঁজির (কোয়াসি ইক্যুইটি) মাধ্যমে করা হয়। মেয়াদ শেষে অথবা সুবিধাজনক সময়ে ভেঞ্চার ফার্ম সেই শেয়ার বিক্রি করে দিতে পারে। এক্ষেত্রে লাভ বা লোকসান যেকোনো কিছুই হতে পারে। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল একটি উদ্যোগের বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থায়ন করে- (১) সিড বা বীজ পর্যায়, যখন ব্যবসা উদ্যোক্তার মনে আইডিয়া আকারে থাকে (২) প্রাথমিক পর্যায়, যখন উদ্যোক্তা ব্যবসা শুরুর জন্য কাজ শুরু করেছে কিন্তু বিক্রয় বা সেবা প্রদান শুরু হয়নি (৩) সম্প্রসারণ পর্যায়, যখন বিক্রি শুরু হয়েছে কিন্তু কোম্পানি লাভ করছে না এবং (৪) বর্ধিষ্ণু পর্যায়, যখন কোম্পানি ভালো আয় বা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে পরিচিত ভেঞ্চার ক্যাপিটালের মধ্যে আছে বিডি ভেঞ্চার, ফেনক্স ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, বিডি ভেঞ্চার লিমিটেড, মসলিন ক্যাপিটাল লিমিটেড, ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড, বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল লিমিটেড, লংকা বাংলা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, এথেনা ভেঞ্চার এবং ইকুইটি লিমিটেড ইত্যাদি।

০৪. অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টিং

অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টিং বলতে বুঝায় যখন কোন উদ্যোক্তা তার ব্যবসার স্টার্টআপের সময় কিংবা চলমান ব্যবসায় আর্থিক সংকটের সময় অন্য কোন ব্যক্তির নিকট ব্যবসার অংশীদারিত্ব বিক্রির মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করে। অংশীদারিত্ব কেনার মাধ্যমে যিনি বিনিয়োগ করেন তাকে বলা হয় অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর। সাধারণত অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর উদ্যোক্তার কোন আত্মীয়, বন্ধু কিংবা পরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে থাকেন। ব্যক্তির পাশাপাশি কোন প্রতিষ্ঠানও অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর হিসেবে বিনিয়োগ করতে পারে। এ ধরণের ফান্ডিং এর একটি সুবিধা হল সহজেই ইনভেস্টর পাওয়া যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে উদ্যোক্তার সিদ্ধান্ত নেওয়া একটি কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, অংশীদারিত্ব বিক্রির বিনিময়ে তিনি সঠিক পরিমাণ বিনিয়োগ পাচ্ছেন কিনা সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্যদিকে অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরকে নিজের প্রতিষ্ঠানের পার্টনার হিসেবে গ্রহণ করার পর পরবর্তীতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতের মিল ধরে রাখাও কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে।

০৫. ক্রাউড ফান্ডিং

ক্রাউড ফান্ডিং বলতে বোঝায় একটি ব্যবসায় অনেক লোকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিনিয়োগ। সাধারণত বিভিন্ন পণ্য বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ফান্ডিং এর ক্ষেত্রে ক্রাউড ফান্ডিং একটি কার্যকরী পন্থা। ক্রাউড ফান্ডিং এ যারা টাকা তুলতে সহায়তা করে, তাদেরকে প্লাটফর্ম বলা হয়। অন্যদিকে ক্রাউড ফান্ডে যারা অর্থায়ন করেন তাদের বলা হয় ‘ব্রেইকার’। তাদের প্রদত্ত অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার, স্বীকৃতি ইত্যাদি দেয়া হয়। পুরস্কারগুলোর অর্থমূল্যের চেয়ে শুভেচ্ছামূল্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেমন— টি-শার্ট, স্টিকার, ধন্যবাদ জ্ঞাপক পত্র ইত্যাদি। প্লাটফর্ম তাদের সেবার বদলে সার্ভিস চার্জ পেয়ে থাকে।

বিশ্বজুড়ে অনেক জনপ্রিয় হলেও ক্রাউড ফান্ডিং একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ ব্যবস্থা। কেননা এতে জালিয়াতির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত রাষ্ট্রসমুহে ক্রাউড ফান্ডিং এ জালিয়াতি ঠেকাতে প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ক্রাউড ফান্ডিং এখনো সেভাবে জনপ্রিয়তা পাইনি। এর আগে ইক্যাবের পক্ষ থেকে বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এগুলো উল্লেখযোগ্য কোন কাজ করতে পারে নি। তবে যেহেতু বর্তমানে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায় উদ্যোক্তার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে খুব শিঘ্রই ক্রাউড ফান্ডিং এদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

2 thoughts on “ব্যবসার জন্য পুঁজি কোথায় পেতে পারেন?”

Leave a Comment